দরূদ শরীফ হোক অনন্তরের খুরাক..।

 





দরুদ শরিফ পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনের অনেক ফজিলত অর্জন করতে পারি যা ইতিপূর্বে ও  হাজার হাজার নবী ও সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের উম্মতের বুজুর্গরা আমল করার মাধ্যমে দুনিয়াতে নজিরবিহীন প্রমাণ রেখে গিয়েছেন।

দরুদ শব্দটি হল  ফারসি শব্দ। এর অর্থ শুভকামনা বা কল্যাণ প্রার্থনা।

 ইসলামি ধর্মের পরিভাষায় দরুদ বলতে বোঝায় ‘আস সালাত আলান নবী’,

 অর্থাৎ নবীজি (সা.)–এর জন্য শুভকামনা। 

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম উচ্চারণের সময় সর্বদা ‘সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ (অর্থ: আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর) বলা হয়। এটি একটি দরুদ।

 আর একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম আমাদের কানে ভেসে আসার সাথে সাথেই আমাদের উপর নবী করীম সাঃ এর জন্য দরুদ পাঠ করা ওয়াজিব।

দরূদ শরীফের ব্যাপারে যে সকল ব্যক্তিগণ অবহেলার করে, তারা আসলে শুধু নিজেকেই এই বিপুল সওয়াব থেকে মাহরূম করে এছাড়া আর কিছু নয়।

 আর নবীজীর নাম শুনেও তাঁর প্রতি দরূদ না পড়া বড়ই দুর্ভাগ্যের বিষয়।  এটা এতোটাই খারাপ ও মন্দকর্ম যে  এমন ব্যক্তির উপরে  হযরত জিবরাঈল আ. ও বদ দুআ করেছেন, (আল্লাহর পানাহ)!

নবীজির উপরে আমাদের দরূদ না পাড় করলে কতো কঠিন হুঁশিয়ার তা এই হাদিস এ খেয়াল করলেই আমরা বুজবো।

যে ব্যক্তি নবীর নাম্ শুনে ও দরূদ না পড়ে এমন ব্যক্তির জন্য কঠিন ওয়ীদ (সতর্কবাণী) বর্ণিত হয়েছে।  

হাদীসটি হলো :--

 কাআব বিন উজ্রা রা. ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত-

একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করলেন। তিনি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে উঠলেন তখন বললেন ‘আমীন’। দ্বিতীয় সিঁড়িতে উঠেও ‘আমীন’ বললেন এবং তৃতীয় সিঁড়িতে উঠেও বললেন, ‘আমীন’! 

আমরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে নবীজী উত্তরে ইরশাদ করলেন-

মিম্বরে আরোহণের সময় আমার কাছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এলেন (এবং তিনটি বদদুআ করলেন, আর আমি তাঁর প্রত্যেক বদদুআর উপর ‘আমীন’ বললাম)।

আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলাম, তিনি বললেন- ওই ব্যক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত না হোক, যে রমযান মাস পেল। তারপরও তার গোনাহ ক্ষমা করা হল না। আমি বললাম, ‘আমীন’!

যখন দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলাম, তিনি বললেন- ওই ব্যক্তি কল্যাণপ্রাপ্ত না হোক, যার নিকট আপনার নাম উল্লেখ করা হল। তা সত্ত্বেও সে আপনার প্রতি দরূদ পড়ল না। আমি বললাম, ‘আমীন’!

তৃতীয় সিঁড়িতে উঠলে তিনি বললেন- ওই ব্যক্তিরও কল্যাণ না হোক, যে পিতা-মাতার উভয়কে বা তাদের একজনকে বার্ধক্যে উপনীত পেল। কিন্তু তারা তার জন্য জান্নাতে প্রবেশের কারণ হল না (অর্থাৎ সে তাদের খেদমত করে জান্নাত কামাই করতে পারল না)। আমি বললাম, ‘আমীন’! -(মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭২৫৬; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০৯; আলকাওলুল বাদী, পৃ. ২৯২)

** দরূদ শরীফ এতটাই বরকত যে,রাসূলের কোনো উম্মত যদি রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করে তাহলে তা ফেরেশতারা রাসূলের কাছে পৌঁছে দেয়।

 এ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহর কিছু সংখ্যক ফেরেশতা রয়েছেন, তারা পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকেন এবং আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমার কাছে সালাম পৌঁছে দেয়। (নাসায়ী ও দারেমি)। 

আল্লাহর কাছে ইবাদত-বন্দেগি গ্রহণযোগ্য করতে পরম ভক্তি ও ভালোবাসাভরা অন্তরে নিবিষ্টভাবে নবী করিম (সা.)-এর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা একটি নেক ও আমল। 

দোয়া কবুলের জন্য মহানবী (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি আমাদের জন্য।

দরুদ শরিফ পাঠ করলে আল্লাহর দরবারে ইবাদতের বিনিময় সুনিশ্চিত হয়। দরুদ পড়া এমন এক ইবাদত, যা করলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের দোয়া কবুল করেন।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা ও নবীর জন্য দোয়া করেন। হে বিশ্বাসীগণ, তোমরাও নবীর জন্য দোয়া করো ও পূর্ণ শান্তি কামনা করো।’

 (সুরা আহজাব, আয়াত: ৫৬)


*** দরুদ পাঠের রয়েছে অনেক বরকতে অনেক উপকার রয়েছে 

••  দরুদ পাঠের বরকতে গায়েবি সাহায্য :

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত— একবার এক ব্যক্তি মরুভূমি পার হচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ডাকাতেরা তাকে আক্রমণ করল এবং তার সব সম্পদ লুট করে নিল। সে ভীত হয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি দরুদ পাঠ করতে শুরু করল। ঠিক তখনই হঠাৎ কোথা থেকে যেন একদল অশ্বারোহী এসে ডাকাতদের আক্রমণ করল এবং তাকে উদ্ধার করল। ডাকাতেরা পালিয়ে গেল। সে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আপনারা কারা?" অশ্বারোহীরা বললেন, "তুমি যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ওপর দরুদ পাঠ করছিলে, তখন আল্লাহ আমাদেরকে তোমার সাহায্যে পাঠিয়েছেন।"

(কিতাবুশ-শিফা, ইমাম ক্বাযী আয়াদ, ২/৬০২)


•• দরুদ পাঠের বরকতে কবরের আজাব থেকে মুক্তি :

হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার জান্নাতের বাগানে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি বললেন—

"যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ ﷻ তার কবরের আজাব মাফ করে দেবেন এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেবেন।"

(মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস: ৪৮৮)


•• দরুদ পাঠের বরকতে অন্ধ ব্যক্তি দৃষ্টি ফিরে পাওয়া :

হযরত উসমান ইবন হানিফ (রা.) থেকে বর্ণিত— এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বললো, "ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার দৃষ্টি চলে গেছে, আমি কী করতে পারি?" রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, "তুমি ওজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়ো এবং এরপর এই দু'আ করো— "আল্ল-হুম্মা সল্লি আ'লা মুহা'ম্মাদিন ওয়াশফি'নি" অর্থাৎ (হে আল্লাহ! রাসুলুল্লাহর বরকতে আমাকে শিফা দান করুন)। 

অন্ধ ব্যক্তি এই আমল করলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই অলৌকিকভাবে তার দৃষ্টি ফিরে পেল।

(তিরমিজি, হাদিস: ৩৫৭৮, নাসাঈ: ১২৫৮)


•• দরুদ পাঠের কারণে রোগমুক্তি :

একবার এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বলল— "ইয়া রাসূলুল্লাহ ﷺ! আমি কঠিন রোগে আক্রান্ত, কিছুতেই সুস্থ হচ্ছি না।" রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন— "তুমি বেশি বেশি দরুদ শরীফ পড়ো, আল্লাহ তোমাকে শিফা দান করবেন।" 

সে নিয়মিত দরুদ পাঠ করতে শুরু করলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল।

(আল-কাওকাবুদ দুররী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৪৫)


••  দরুদ পাঠের বরকতে ঋণ থেকে মুক্তি :

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত— এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে এসে বললো, "আমি প্রচণ্ড ঋণের মধ্যে পড়ে গেছি।" রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন— "তুমি প্রতিদিন ১০০ বার দরুদ শরীফ পড়ো, আল্লাহ তোমার ঋণ মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবেন।" 

সে নিয়মিত দরুদ পড়তে লাগলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

(দারেমি, হাদিস: ২৭৫৫)


••  দরুদ পাঠের বরকতে অভাব দূর হওয়া :

ইমাম ইবনে জাওযী (রহ.) তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন— এক ব্যক্তি দারিদ্র্যে এতটাই কষ্ট পাচ্ছিল যে, তার কাছে খাবার কেনার মতো টাকাও ছিল না। একদিন সে এক আলেমের কাছে গিয়ে বলল, "হুজুর, আমি প্রচণ্ড অভাবে আছি, কী করলে আমার অভাব দূর হবে?" আলেম বললেন, "তুমি প্রতিদিন ১০০০ বার দরুদ শরীফ পড়ো, আল্লাহ তোমার অভাব দূর করে দিবেন।" 

সে এই আমল শুরু করলো এবং কিছুদিনের মধ্যেই তার রিজিকের দ্বার খুলে গেল। সে ধীরে ধীরে এত ধনী হয়ে গেল যে, সে নিজেই গরিবদের দান করা শুরু করল।

(কিতাবুল আওরাদ, ইমাম ইবনে জাওযী, পৃষ্ঠা ২৯৭)


••  দরুদ পাঠে ক্ষমার সুসংবাদ প্রাপ্তি :

হযরত উবাই ইবন কাব (রা.) বলেন— আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বললাম, "আমি দু'আর মধ্যে আপনার জন্য কতটুকু দরুদ রাখব?" তিনি বললেন, "যত বেশি পারো।" আমি বললাম, "আমার দু'আর অর্ধেক কি আপনার জন্য দরুদ রাখব?" তিনি বললেন, "এটিও ভালো, তবে বেশি করলে আরও ভালো হবে।" আমি বললাম, "তাহলে আমি আমার দু'আর পুরো সময় আপনাকে দরুদ পড়তে ব্যয় করব।" তিনি বললেন, "তাহলে তোমার সব চিন্তা ও দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।"

(তিরমিজি, হাদিস: ২৪৫৭)


•• দরুদ পাঠের বরকতে বিপদ থেকে মুক্তি প্রাপ্তি :

হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি সাগরপথে সফর করছিলেন। হঠাৎ ঝড় শুরু হলো এবং নৌকাটি ডুবে গেল। সবাই পানিতে পড়ে গেল, কিন্তু ওই ব্যক্তি পানিতে ডুবতে ডুবতে দরুদ পাঠ করতে লাগলেন। হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক কাঠের টুকরো ভেসে এলো এবং সে সেটাতে চড়ে বেঁচে গেল। 

সে বলল, "আমি যখন বুঝতে পারলাম, মৃত্যু ব্যতীত কোনো উপায় নেই, তখন দরুদ পাঠ শুরু করলাম। আল্লাহ ﷻ তার রহমতে আমাকে রক্ষা করলেন।"

(শারহু শিফা, ইমাম খাফাজি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬০৫)


•• দরুদ পাঠের বরকতে জান্নাতের সুসংবাদ

 লাভ :

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বর্ণনা করেছেন— এক ব্যক্তি নিয়মিত দরুদ শরীফ পড়তেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখলেন। 'রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে বললেন, "তোমার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ আছে, কারণ তুমি জীবনে নিয়মিত আমার প্রতি দরুদ পাঠ করেছ।" 

সকালে সে উঠে আলেমদের কাছে গিয়ে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তারা বললেন, "দরুদ পাঠকারীর জন্য জান্নাতের সুসংবাদ স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ দিয়েছেন, তোমার জন্য এটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার।"

(তাফসির কুরতুবি, খণ্ড ১০, আয়াত ৫৬-এর ব্যাখ্যা)

••  দরুদ পাঠের বরকতে স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দিদার লাভ :

হযরত আবু ইয়াজিদ (রহ.) বলেন— আমি একদিন এক আলেমের কাছে শুনলাম, "যে ব্যক্তি নিয়মিত ১০০০ বার দরুদ পাঠ করবে, সে স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখতে পাবে।" আমি এই আমল শুরু করলাম। একদিন দরুদ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতের বেলা স্বপ্নে আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখলাম। তিনি আমাকে বললেন, "হে ইয়াজিদ! তুমি নিয়মিত আমার প্রতি দরুদ পাঠ করো, আল্লাহ তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করবেন।" 

আমি ঘুম থেকে উঠে আনন্দে কেঁদে ফেললাম এবং সারা জীবন দরুদ পাঠকে আমার জীবনের অংশ বানিয়ে নিলাম।

(তাফসির কুরতুবি, খণ্ড ১০, আয়াত ৫৬-এর ব্যাখ্যা)


•• দরুদ পাঠের বরকতে মৃত্যু-মূহুর্তে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাক্ষাৎ লাভ :

হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন— এক বৃদ্ধ ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি খুব শান্ত ছিলেন এবং বারবার বলছিলেন, "রাসূলুল্লাহ ﷺ এসেছেন, তিনি আমাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন।" তার পরিবার বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি কী কারণে এই মর্যাদা পেলেন?" তিনি বললেন, "আমি জীবনে কখনও কোনো নামাজ বাদ দেইনি এবং আমি প্রতিদিন ৫০০ বার দরুদ পাঠ করতাম।" 

কথা শেষ করেই তিনি হাসিমুখে ইন্তেকাল করলেন।

(রুহুল বায়ান, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৭৮)

আল্লাহ আমাদেকে বেশি বেশি দরূদ পাড় করার তাওফিক দান করুণ। 

আমীন.......!








Comments